বিবাহিত জীবনে বা বিয়ের পর প্রতিটা মেয়েকে কতটা সংগ্রাম আর চ্যালেঞ্জ এর মধ্য দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার গড়তে হয় সেটা শুধুমাত্র একজন কর্মজীবি নারী বা একজন কর্মজীবি মা-ই উপলব্ধি করতে পারেন। একটি ছেলের পাশাপাশি একটি মেয়েকে যখন তাঁর বাবা মা বা অভিভাবক লেখাপড়া শিখিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন তখন সেই মেয়েটির যেমন অনেক স্বপ্ন থাকে তেমনি তার অভিভাবকদেরও অনেক স্বপ্ন থাকে তাদের কন্যা সন্তানটিকে নিয়ে, তাঁর সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ ঘিরে। আমি যখন ইংরেজি সাহিত্যে অনার্সে পড়ি তখন আমাদের একজন ম্যাডাম ছিলেন, নাম ফাহমিদা খানম। আমার খুব পছন্দের শিক্ষক ছিলেন, একদিন তিনি ক্লাসে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন সবাই ইংরেজি বিষয়টাকে পছন্দ করলেন, আরও তো অনেক বিষয় ছিল। তখন আমার অনেক সহপাঠী বন্ধুরা যুক্তি দেখিয়েছিল ইংরেজি একটি রয়েল সাবজেক্ট, ভালো ডিমান্ড, সেকেন্ড ল্যাংগুয়েজ, টিচিং প্রফেশানের জন্যও ভালো সুইটেবল ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন ম্যাডাম জিজ্ঞেস করলেন ইংরেজি সাহিত্যে ডিগ্রি নিয়ে কার কার চাকরি বা শিক্ষকতা করার ইচ্ছে। অবাক করা হলেও সত্য মাত্র এক তৃতীয়াংশ মেয়ে শিক্ষার্থী হাত তুলেছিল তারা নিজেরা কিছু করতে চায়। খুব প্রয়োজন না হলে দুএকজন বলেই ফেলেছিল তারা জব করবে না, একটা ভালো সাবজেক্ট নিয়ে পড়ার উদ্দেশ্য একটি ভালো বিয়ে হওয়া, এটা ম্যাডামের বুঝতে বাকি রইল না। ম্যাডাম সবসময় বলতেন লেখাপড়া করে শুধু ভালো একটি বিয়ে করা একটা মেয়ের কখনোই একমাত্র লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হতে পারে না। মেয়েটিকে অবশ্যই নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে হবে। তারপর তিনি নিজের জীবনের সংগ্রামের কথা বলেছিলেন, কিভাবে স্টুডেন্ট অবস্থায় বিয়ে করে, পরপর দুটো বাচ্চা নিয়ে প্রতিকূল পরিবেশও তিনি খুব ভালো ফলাফল করে নিজের প্রতিষ্ঠানেই আজ তিনি শিক্ষক। আজ থেকে দেড় যুগের আগের কথা শেয়ার করলাম। হে তখন বা তারও আগে মেয়েদের অনেক কিছু করার সুযোগ ছিল, কারণ তখন যৌথ পরিবার ছিল, বাচ্চা দেখাশোনা করার জন্য পরিবারে লোকজন ছিল তখন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বর্তমানের ন্যায় ছিল না তাই কাজের লোকেরও অভাব ছিল না, এখন চিত্র পুরো ভিন্ন। এখন একটি উচ্চশিক্ষিত বিবাহিত বা সাংসারিক মেয়েকে অনেক সংগ্রাম করে ও অনেক চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার গড়তে হয়, আগের মত যৌথ পরিবার নেই, তাই বাবা মা শ্বশুর শাশুড়ী বা ভাই বোন দেবর ননদের সাপোর্ট পাওয়া যায় না; অতীতের মত গৃহপরিচারিকাও পাওয়া বেশ দুর্লভ।
অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীকে সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে জব বা বিজনেস ছেড়ে দিতে দেখেছি, অনেককে দেখেছি ক্যারিয়ার বা জবের জন্য সন্তান ই নিচ্ছেন না, আবার অনেকে একটা নিয়েছেন কোন রকমভাবে। ক্যারিয়ারের জন্য যারা সন্তান নিতে পারেননি তাঁরও খুব একটা ভালো নেই নিঃসন্তানের কারণে, তাদের অনেক কিছু থাকার পরেও মনে হয় নিঃস্ব, কিছু নেই। আবার যারা এরই মধ্যে সন্তান নিয়ে জব বা বিজনেস করছেন তাঁরাও বিভিন্ন জটিলতা ফেইস করে করছেন, অনেক সময়ই বাচ্চাদের পূর্ণ নিরাপত্তা দিতে পারছেন না আর তখনই বাচ্চাদের জীবনে ঘটে নানা বিপত্তি, দুর্ঘটনা। যৌথ পরিবার ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে, বাবা মায়ের ব্যস্ততার দরুন অনেক বাচ্চাই একা একা মানুষ হয়, তার পরিণামে অনেক বাচ্চাদের মাঝেই পারাবিরিক সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, ভালোবাসা, ধৈর্য্য, ত্যাগ এই গুণাবলীগুলো সেভাবে তৈরি হয় না বা তারা ধারণ করতে পারে না। আর তাই আজকাল বাচ্চাদের মধ্যে ধৈর্য্য সহিষ্ণুতা অনেক কমে গিয়েছে, অল্পতেই তারা স্পর্শকাতর হয়ে যাচ্ছে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে উঠছে চরমভাবে। অনেক মেধাবী সন্তান অল্পতেই ধৈর্য হারিয়ে অকালে ঝরে যাচ্ছে। বিগত পাঁচ মাসে ৪৭৮ জন শিশু কিশোর ও উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ে আত্মহত্যা করেছে। বেশিরভাগ ঘটনাই পরিবারের উপর অভিমান করে ঘটেছে, অনেক মেয়েরাও ভুক্তভোগী আছে, যারা এলাকার বখাটে ছেলেদের উৎপাত বা অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার মত পথ বেছে নিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে আমেরিকান মডার্ণ পিরিয়ড এর বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সউল বিলোর লেখা “সিজ দ্যা ডে’ নভেলের মূল চরিত্র টমি উইলহেলম এর নিঃসঙ্গ জীবনের সাথে আমাদের অনেকের জীবন বাস্তবতা মিলে যায়। মানুষ ক্রমাগত অর্থ ও ক্যারিয়ারের পেছনে ছুটতে গিয়ে অতিমাত্রায় যান্ত্রিক জীবনে প্রবেশ করে অনুভূতিহীন হয়ে পড়ছে, পারিবারিক ও সমাজিক সম্পর্কগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে লালন পালনের অভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। মানুষ দিনে দিনে নিঃসঙ্গ হয়ে যাচ্ছে,,,
লেখিকাঃ রাজিয়া রহমান (লেখক, শিক্ষক ও বাচিক শিল্পী)