মোহাম্মদ ওমর ফারুক দেওয়ান
বঙ্গবন্ধু- বাঙালি জাতির মুক্তির প্রতীক, স্বাধীনতার প্রতীক। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ীতে, জাতির পিতার ১০৩তম জন্মদিনে, তাই তাঁর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। কৃতজ্ঞতা এই জন্য যে, তাঁর নেতৃত্ব ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হতো কিনা ঘোরতর সন্দেহ আছে। তিনি দেশ স্বাধীন করেছেন বলেই আমি আজ তিনশো ফুট আয়তনের একটা অফিসকক্ষে অফিস করছি, নতুবা আমি বড়জোর কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কেরানী হতাম। পুরাতন পত্রপত্রিকা পড়া আমার অভ্যাসের একটা অংশ, প্রকৃত ইতিহাস জানার তাগিদে, রংচংয়ে ইতিহাস নয়। তাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা অনেক পত্রিকাই পড়েছি, এখনো পড়ি।
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ১৯৭১ সালের সংগ্রামমুখর ১৭ই মার্চে তাঁর ৫২তম জন্মদিন ছিল। ততদিনে তিনি বাংলার অবিসম্বাদিত নেতা ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে গেছেন। তাই তাঁর জন্মদিনও আলোচনার বিষয়ে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশি বিদেশি সাংবাদিকরা জন্মদিন পালন নিয়ে কুশল বিনিময় করতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দুঃখী বাংলার অনাহারী মানুষেরা তাদের জন্মদিনের বার্তা বোঝে না, আমিও তাই বুঝতে চাইনা, কারণ আমি যে তাদেরই একজন।’ তিনি বলেন, ‘আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুখিনী বাংলায় আমার জন্মদিনই বা কী আর মৃত্যুদিনই বা কী? আপনারা বাংলাদেশের অবস্থা জানেন। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আর নেই কোন মহিমা। যখনই কারো ইচ্ছা হলো আমাদের প্রাণ দিতে হয়।’ তিনি যখন এ কথাগুলো বলছিলেন আবেগে তাঁর কন্ঠ রূদ্ধ হয়ে এসেছিল।
জন্মদিন সবাই সাধারণত ঘরোয়াভাবে পালন করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অধিকাংশ জন্মদিন গেছে জেলের অন্ধকার প্রকোষ্টে। বঙ্গবন্ধুর কারাবাসের জন্মদিন কিভাবে পালিত হতো-এমন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা বলেন,
“যে কয়টা জন্মদিন তিনি জেলে কাটিয়েছেন সেই মুহুর্তগুলোতে বিশেষ এই দিনটাকে (জন্মদিনকে) আমাদের সকলের বেশি করে মনে পড়েছে। তাই এই তারিখটাতে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি চেয়ে অনেক আগে থেকেই জেল কর্তৃপক্ষের কাছে ধরনা দিতাম। একবার কি দু’বার হুকুমও পেয়েছিলাম। দেখা করার সময় তাই নিয়ে গিয়েছিলাম ফুল, কিছু মিষ্টি আর গোটা কয়েক বই সামান্য কটা জিনিস। তবুও সহজে ছাড়পত্র পাইনি। অনেক কষ্টে যখন উপস্থিত হয়েছি তাঁর সামনে। ফুলগুলোর দিকে চেয়ে ভাল লাগার আমেজে চিকচিক করে উঠেছে তাঁর উজ্জ্বল চোখের তারা। নীরবে তাঁকে জন্মদিনের শুভ কামনা জানিয়ে ফিরে এসেছি আমরা।” (দৈনিক বাংলা, ১৭ই মার্চ, ১৯৭৩
১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ, স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন উপলক্ষ্যে তিনি বাণী দিয়েছিলেন। বাণীতে তিনি লেখেনঃ
“প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ সরকারের আমার সহকর্মীবৃন্দ আমার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে ১৭ই মার্চ সরকারী ছুটি ঘোষণা করিয়াছেন।
“আপনাদের স্মরণ আছে যে, সে সময় আমি ছিলাম ফ্যাসিস্ট কারাগারে বন্দী। সেই জন্য আমি তাঁহাদের ধন্যবাদ জানাই। এ ক্ষণে আমি জনগণের নিকট ফিরিয়া আসিয়াছি। তাঁহাদের মধ্যেই আমি বাস করিতে চাই। আমি তাঁহাদের জন্য তাঁহাদের সুখে-দুঃখে কাজ করিতে চাই।
“আমার বিবেচনায় ১৭ই মার্চ সাধারণ ছুটি থাকা ঠিক নয়। বরঞ্চ সামনের কঠোর কর্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি এই দিন আরও কঠোর পরিশ্রম ও গৌরব অর্জনের উদ্দেশ্যে নিষ্ঠার সহিত কাজ করার দিনরূপে পরিগণিত হওয়া উচিত।
“তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়াছি যে, ভবিষ্যতে ১৭ই মার্চ তারিখে ছুটি থাকিবে না। তবে ভারতের মহান প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সফর উপলক্ষ্যে এবং তাঁহার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসার নিদর্শনরূপে চলতি বৎসর ১৭ই মার্চ সাধারণ ছুটি পালন করা হইবে।”ৃ
রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা চমৎকার মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শ কেবল সোনার বাংলাকে গড়িয়া তুলিবে না, উপরন্তু বিভ্রান্ত বিশ্বের সামনে ধ্রুবতারার মত উজ্জ্বল পথ নির্দেশক হইয়া উঠিবে।” তিনি বলেন, “আপনি একজন ব্যক্তিমাত্র নন, আপনিই একটি জাতি, সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাংখার প্রতীক।”
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ ‘বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন’ শিরোনামে সম্পদকীয়তে লিখে, “ৃনিজ সংগঠনী প্রতিভা, প্রখর ব্যক্তিত্ব আর অসাধারণ দূরদৃষ্টি বলেই শেখ মুজিব মৃতপ্রায় বাঙালী জাতিকে বিশ্বের ইতিহাসে সংগ্রামী জাতি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন।”
দৈনিক বাংলা ওই দিন ‘জন্মদিন, নতুন সংগ্রাম’ শিরোনামে সম্পাদকীয়তে লেখে,ৃ “আজ সেই দিন, যেই দিনকে বলা যায় বাঙালী জাতীয়তাবাদের জন্মদিন-বাঙালীর পূর্ণ মুক্তির শুভ সূচনার জন্মলগ্ন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে শেখ মুজিব আজ আর একটি নাম, একটি ব্যক্তিত্ব শুধু নয়-মুজিব আজ একটি ইতিহাস, একটি কিংবদন্তী।”ৃ.“বাঙালী মরেছে কিন্তু যুদ্ধকে ছাড়েনি-শেখ মুজিবের নির্দেশিত পথ থেকে সরে দাঁড়ায় নি, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানকে ভূলে যায়নি। আর এমনি করেই বাংলাদেশের রক্তের নদীতে জন্ম নিয়েছে এ নতুন ইতিহাস নতুন কিংবদন্তী। ত্রিশ লক্ষ বাঙালীর বুক থেকে ঝরে পড়া রক্তে রচিত হয়েছে এ নতুন ইতিহাস-সৃষ্টি হয়েছে এ নতুন কিংবদন্তীর। এ ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিব, এ কিংবদন্তীর রাজপুত্র শেখ মুজিব। বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে বাঙালী জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে এ ইতিহাসের মহানায়ক ও কিংবদন্তীর রাজপুত্র ততদিন এক অনির্বান জ্যোতিতে আমাদের দেশ অনুভব করবে এবং আকাঙ্খায় উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। শেখ মুজিব ত্রিশ লক্ষ শহীদ বাঙালীর বিদেহী আত্মার জীবন্ত স্মৃতির মিনার। সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীর সকল আকাঙ্খার প্রতিমুর্তি।”
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে দেশের প্রসিদ্ধ কবিরা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছেন- সিকান্দর আবু জাফর, শঙ্খ ঘোষ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সৈয়দ আলী আহসান, জসীমউদ্দীন, সুফিয়া কামাল, কায়সুল হক, বনফুলসহ অনেকে।
এর মধ্যে কবি সিকান্দর আবু জাফর তাঁর ‘সে-নাম মুজিব’ কবিতার প্রথম প্যারায় লিখেছেনঃ
পূত মাতৃ অঞ্চলের প্রসন্ন আশ্রয়ে
সন্তানের কলকণ্ঠ ছিঁড়ে গেলে ভয়ার্ত বিস্ময়ে
থেমে গেলে হাতে হাতে খেজুর পাতার পাটি বোনা
দু দন্ড কৌতুক মেলে শঙ্খচিল অথবা ঘুঘুর কণ্ঠে
কয়টি নতুন গল্প শোনা
সদ্যফোটা শাপলার পরিতৃপ্ত আত্মসমর্পণে
অঙ্কিত বিচিত্র ছবি মুছে গেলে পুকুরের নিটোল দর্পণে
কবরের শ্মশানের অকস্মাত লাঞ্চনা যখন
বন্দী করে নিয়ে যায় ঘরে ঘরে
মুর্ছাহত বাঙালীর মন
তখন যে-নাম
পিতার বক্ষের মত নির্ভরতা
মেলে ধরে বলে
ভয় নেই, কল্যাণের ধ্রুব পদতলে
চুর্ণ হবে অসত্য অশিব,
সে-নাম মুজিব।ৃ..
কবি জসীমউদ্দীন তাঁর ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় লিখেছেনঃ
“মুজিবুর রহমান
ওই নাম যেন বিসুভিয়াসের অগ্নি-উগারী বান।”ৃ..
জাতির পিতা, বাঙালি জাতির সহস্র বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান লিখে শেষ করার মত নয়। জাতি বিনম্রচিত্তে পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালন করেছে। যুগে যুগে দেশে দেশে শোষিত, বঞ্চিত ও সংগ্রামী মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকুক-জন্মদিনে এই প্রার্থনা।
লেখক: পরিচালক, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর