**রাজিয়া রহমান**
রাখী বারান্দা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে। আকাশটা খুব ঝলমলে, বিশাল, পাখিগুলো ডানামেলে উড়ে যাচ্ছে। বন্দী ঘরের গ্রীল ধরে দাঁড়িয়ে আকাশ পানে চেয়ে আছে রাখী। কখনো কি মুক্ত আকাশের নিচে প্রাণ ভরে আর নিশ্বাস নিতে পারবে? আর কখনো কি স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারবে, চোখ দিয়ে টলটল করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মনে হচ্ছে ওর কান্না দেখার মত পৃথিবীতে আর কেউ নেই। যে রাখী মাকে ছাড়া ঘুমাতে পারতো না, আর আজ বিছানায় একা একা ঘুমাতে হয়, খুব কান্না হয় ওর যেন পৃথিবীতে আর কেউ নেই। বেশ কড়াকড়ি এই মাদ্রাসার নিয়ম কানুন। খুব ভোরে উঠতে হয়, ভোর সাড়ে চারটায় উঠে নামাজ পড়েই তোতা পাখির মত না বুঝেই আরবি মুখস্ত করতে হয়। চারটা সিকিউরিটি গেট, শুধু মেয়েদের জন্য বিশেষায়িত হাফেজিয়া মাদ্রাসা, রাখী আগেই কয়েক পাড়া কোরআন শরীফ মুখস্ত করেছে। সারাদিন চলে এভাবে মুখস্ত বিদ্যা, কোন বৈচিত্র্য নেই। নেই ভালো খাওয়া দাওয়ার সুব্যবস্থা। খাওয়া দাওয়া আছে, কিন্তু সেগুলো রুচিসম্মত নয়। কারও কারও বাসা খুব কাছে, বাসা থেকে খাবার আসে। রাখীদের বাসা ৫/৬ কিলো দূরে হবে তাও এক আত্মিয়ের বাসা। মা এখনো গ্রামের বাড়িতে।
পাশের বাসার ছাদে কুকুর নিয়ে একটা ছোট ছেলে রোজ উঠে সাথে বিড়ালও। ওদের সাথে খেলাধূলা করে, ওদেরকে খাবার দেয়, গায়ে রোদ লাগায়। রাখি তাকিয়ে ভাবে ওর জীবনটাও তো এরকম মুক্ত হতে পারতো। ও কেন আজ বন্দী। এই কিছুদিন আগেও রাখীর খুব সুন্দর একটা জীবন ছিল, যখন ওর বাবা বেঁচে ছিল। রাখীর যখন জন্ম হয়েছিল রাখীর বাবাও পৌরসভার মেয়র পদে বিপুল ভোটে জিতেছিলেন। বাড়ি ভর্তি তখন মানুষ, কি ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ে, সবাই খুব আদর করত। রাখী দেখতে ভীষণ কিউট হয়েছিল, ধবধবে ফর্সা ছিল। ওর বোনেরা কাজিনরা এখনো বলে ও পুরো নাকি পুতুলের মত ছিল দেখতে। খুব আদর করত সবাই। বাবা মা ভাই বোন পাড়া প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজন সকলে মুগ্ধ ছোট্ট শিশুর ভালোবাসায়। রাখী দেখতেও ভীষণ আদুরে ছিল, মায়া মায় ভাব ওর পুরো চেহারায়। বাবা বেঁচে থাকতে ওকে চোখের আড়াল হতে দেয়নি। সারাক্ষন তাঁর চোখের সামনে ওকে থাকতে হত।
গ্রামে তখন ওদের বাড়ির দুপাশে দুটো বিশাল জলাধার, পশ্চিমে একটি দীঘি ও পূর্বে পুকুর। পশ্চিমে দীঘির পাশে একটি মসজিদ , মসজিদটি ওর বাবাই করেছে। দীঘির পশ্চিমে ঈদগাহ মাঠ ও মাঠের পাশে পারিবারিক কবর স্থান, কবর স্থানটি গাছপালা দিয়ে বেশ সজ্জিত।
খুব ভোর বেলা ওকে উঠতে হত , উঠেই মসজিদে যেতে হত। মসজিদ থেকে আরবি পড়ে এসে নাস্তা করে স্কুলে যেতে হত। বেশ নিয়মের মধ্য দিয়েই বেড়ে উঠেছে রাখী ও তাঁর ভাই বোনেরা। বড় ভাই বোন সবাই ওর খেয়াল রাখতো। ওর বাবা বেশি খেয়াল রাখতো, তাঁর শেষ জীবনে রাখীর জন্ম। যখন তিনি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত একজন জনপ্রতিনিধি। তাঁর সবসময় দুশ্চিন্তা ছিল রাখী পানিতে পড়ে যায় কিনা। তাই কাজের মানুষ সহ সবাইকে লাগিয়ে রাখতো ওকে দেখার জন্য।
যখন গ্রামে ছিল নিয়ম করে খেলাধূলা পড়াশুনা চলত।
অনেক বড় জায়গা নিয়ে ওদের বাড়ি, এমন কোন দেশীয় ফল খুঁজে পাওয়া ভার, যেগুলো ওদের বাড়িতে ছিল না। আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু, আতা শরীফা, বেল, কামরাঙা, আমড়া, ডেউয়া আরও অনেক জাতের ফলের গাছ ছিল ওদের বাড়ি। ঝর এলে আম কুড়ানো ছিল রাখীর অন্যতম শখের কাজ। বিকেল বেলা পাশের বাড়ির সুমি ও ইতির সাথে ও প্রচুর খেলাধূলা করত, বউচি, হাড়িপাতিল, পুতুল খেলা, গোল্লা ছুট, ফুল টোক্কা সহ আরও অনেক মজার খেলা । রাখীর মায়ের কাছ থেকে অনেক ছড়া শিখেছে রাখী, সেই সাথে বাংলা ও ইংরেজি বর্ণমালা। আরবি অনেক সুরা মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে মুখস্থ করে ফেলেছে রাখী। রাখীর বেশ কয়েকজন হিন্দু বন্ধুও ছিল। ওরাও ওদের বাড়ি এসে খেলাধূলা করত, রাখীও ওদের পূজা পার্বণে ওদের বাড়ি যেত, ওদের বড় ভাই বোনের বিয়েতেও যেত। রাখীর মনে খুব প্রশ্ন জাগতো, সবাই তো মানুষ তবে কেন এত ধর্ম এত বিভাজন, এত রীতিনীতি।
সকালবেলা উঠোনে বসে রোদ লাগাতো ওরা, একসাথে বিকেলে সব ভাই বোন মিলে বিভিন্ন ধরনের পিঠা, পায়েস, বাদাম ভাজা, ছোলা ভাজা, মুড়ি মাখানো, পেয়াজু, চপ, আলু পোড়া খেত মজা করে সবাই মিলে। রাখীর মা শীত কি গ্রীষ্ম প্রায় প্রতিদিনই পিঠা বানাতেন গৃহকর্মী সাথে নিয়ে, খুব ভালো পিঠা বানাতে পারতেন তিনি পাখোয়ান, বাপা, চিতই, দৌল্লা, সংশা, নাড়ু, ছিৎ পিঠা, সেমাই পিঠা, পাতা পিঠা ইত্যাদি। মসজিদের পাশেই ছিল বিশাল ঈদগাহ্ মাঠ।
ঈদগাহ্ মাঠে প্রায় প্রতিদিনই খেলা হত, খেলা জমতো আবাহনী মোহামেডান এর। রাখীর কাজিনরা মিলে ছিল ৮ ভাই, ভাইরা সবসময় প্রতিযোগিতায় যেত রাখীকে সাপোর্টার বানাতে। এইজন্য চকোলেট খেলনাসহ নানারকম সামগ্রী কিনে দিত, রাখী যখন যার কাছ থেকে উপহার পেত তাঁর দলের সাপোর্ট করত, বেশ ডিপ্লোমেটিক সে। সবাই ওকে ভীষণ আদর করত। ওর বাবা, ভাইরা ওকে নিয়ে মসজিদে যেত, বাজারে যেত, মজার মজার খাবার কিনে দিত। সকলের যেন চোখের মণি ছিল, ওর বিশেষ আদুরে ও মায়াভরা ব্যক্তিত্বের জন্য সবাই ওকে ভীষণ পছন্দ করত।
রাখীর এমন আনন্দ ও সুখের দিন বেশিদিন ছিল না
অনেক আদরের শৈশবে হঠাৎ বজ্রপাত ও ঝরে লন্ডভন্ড হয়ে গেলো সব। রাখীর বাবা ঢাকা ও উত্তরবঙ্গে একটা ট্যুরে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে যান। ঢাকায় এসে তিনি সুস্থ হন আবার হঠাৎ করে কোমায় চলে যান। তারপর ছয়মাস কোমায় থেকে হসপিটালের আইসিইউ ও বাসা সব মিলিয়ে ছয় মাস বেঁচে চিলেন। ডাক্তার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, আর ফিরবেন না। ঠিক কোরবাবনী ঈদের আগের দিন তিনি না ফেরার দেশে চলে যান। তখন আর সে ঈদ তো আর ঈদ হল না, পুরো পরিবারে শোকের ছায়া নেমে এল। ওদের গ্রামের কেউ সেদিন ঈদ করেনি। পুরো গ্রাম যেন ছিল শোকের ছায়ায় ঢাকা। জনপ্রতিনিধি হওয়ার কারণে তিনি পুরো পৌরসভার সবকটি গ্রাম নিজের সন্তানের মত আগলে রাখতেন। চারটি জানাজা পড়তে হয়েছিল রাখীর বাবার জন্য। অনেক ভালোবাসা পেয়েছেন তিনি মানুষের কাছ থেকে।
এখনো কোরবানির ঈদটি রাখীদের পরিবারে শোকের ঈদ। রাখীর বয়স মাত্র আট বছর তখন, মাথার উপর থেকে ছাতা সরে গেলো, রাখীও বুঝতে পারলো। তখনো তিন ভাই তিন বোন পড়াশোনা করছে। বড় ভাই বোন পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। মেঝো বাই বাড়ি এসে তিনি রাখীকে নিয়ে যেতে চাইলেন আরবি পড়াতে। তাঁকে আরবি পড়াতে চেয়েছিলেন তাঁর বাবা। তিনি পড়েন নি, তাঁর অসমাপ্ত কাজটি তিনি রাখীকে দিয়ে সমাপ্ত করবেন। রাখীকে নিয়ে গেলেন মায়ের আঁচল থেকে, যে মায়ের আঁচল তলে রাখী ঘুমাতো, যে মাকে ছেড়ে একটা দিন থাকেনি, থাকতে পারেনি কোথাও। আজ মেঝো ভাইয়ের হাত ধরে অজানা পথে পাড়ি দিবে সে। রাখী ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো, প্রতি ক্লাসেই প্রথম ছিল, এবার তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলো সে। তবুও তাকে চলে যেতে হবে, অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে যেতে হবে বাবা মায়ের ভিটা ছেড়ে, মাকে ছেড়ে। মেঝো ভাই রাখীকে ঢাকায় নিয়ে এলেন নিজের বাসায়, সরকারি চাকুরির সুবাদে সরকারি কলোনিতে থাকতেন তিনি। রাখীও বেশ আদর যত্নেই থাকতেন, তারা ছিলেন নিঃসন্তান। বাসায় ইমাম সাহেব রেখেছিলেন ওকে পড়ানোর জন্য। মসজিদে গিয়েও পড়তে হত রোজ। স্কুলের পড়া একেবারে বন্ধ। কোরআান শরীফ না বুঝেই মুখস্ত করতে হবে। কোরআন শরীফ পাঠ করলেই সওয়াব, বুঝুক আর না বুঝুক, ইমাম সাহেব তাই বলেন। খুব অল্প সময়েই চার পাড়া মুখস্ত করে ফেললো রাখী। একদিন ইমাম সাহেব বললেন, এভাবে পড়লে হাফেজ হতে পারবে না, মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিতে হবে। মাদ্রাসায় থেকে পড়তে হবে। রাখীর ভাইও পুরো ঢাকা শহর খুঁজে বেড়ালেন, তারপর একবছর পর খুঁজে পেলেন ঢাকার মিরপুরে একটি মহিলা মাদ্রাসা, সেখানে মেয়েদের হাফেজ বানানো হয়। সেখানে নিয়ে গেলেন রাখীকে, রাখী মাদ্রাসার ভেতরে ঢুকে পুরো মাদ্রাসা দেখলেন, মনে মনে কস্ট পেতে লাগলো কি করে এই বন্দী পরিবেশে থাকবে, সে যে মুক্ত পাখির ন্যায় বাঁচতে চায়। মাদ্রাসা থেকে বের হওয়ার পর রাখীর মন খুব খারাপ হল, সে এখানে ভর্তি হতে চায় না। এখানে বন্দী জীবনে সে মা ভাই বোন ছেড়ে একা থাকতে পারবে না, একে তো বাবার শূন্যতা তার উপর সবাইকে ছেড়ে থাকতে হবে। এতদিন ভাইয়ের বাসায় থাকলেও সবাইকে দেখতে পেয়েছে। ভাবতে ভাবতে চোখের জল টল টল করে বেয়ে পড়ল। এ কেমন পৃথিবী রাখী ভাবছে, পৃথিবীটা বদলে যেতে থাকলো মূহুর্তের মধ্যেই। মনে হচ্ছে পৃথিবীতে ওর কেউ নেই, ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন মূল্য নেই। বের হয়ে রাখীর খুব মন খারাপ, ভাবলো ভাই ওকে জিজ্ঞেস করবে ও এখানে থাকতে পারবে কিনা অথবা থাকতে আগ্রহী কিনা। না, ভাই কিছুই জিজ্ঞেস করল না। তাই রাখীও কিছু বলল না। বোনের বাসায় চলে গেলো ভাইয়ের সাথে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ফিরে এলো এই মাদ্রাসায়। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই থাকতে হবে এখানে, কিছু করার নেই।
প্রথম দিনটি সবার সাথে পরিচিত হতেই সময় কেটে গেলো। ভোর থেকে রাত ৯ টা পর্যন্ত পড়তে হয়, মাঝে শুধু নামাজের বিরতি,৷ আর দুপুরে পর ১ ঘন্টা ঘুমের বিরতি। শুধু তোতাপাখির মত অর্থ না জেনেই একটি বিদেশি ভাষা মুখস্ত করতে হয় সারাদিন। অর্থ না জেনে বিষয়টি খুব একঘেয়ে লাগে রাখীর নিকট। সারাদিন পর রাতে ঘুমোতে আসলে ওকে পৃথিবীর সকল নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরে, একেবারে একা, সব শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরে। এখানে ওর পৃথক বিছানা। মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে। মাকে জড়িয়ে ধরে খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মাকে কোথায় পাবে, মা তো গ্রামের বাড়ি। আরও একবছর পর ছুটি দিবে মাত্র কয়েকদিনের জন্য। এমনি করে একই রুটিনে কয়েকদিন কেটে গেলো। রাখী বিকেলে না ঘুমিয়ে রুমের পর্দা সরিয়ে পাশের বাড়ির ছাদের দিকে তাকায়। দুই তলা ছাদ, একটি কুকুর নিয়ে রোজ উঠে একটি ছোট ছেলে। কুকুরটির সাথে খেলা করে। রাখী ভাবে এরকম মুক্ত আকাশ কবে দেখতে পাবে। মুক্ত আকাশের নিচে কবে খেলতে পারবে বউচি, সাত চারা, ডাংগুলি, ফুল টোক্কা। পাশ থেকে কেউ একজন ওর ঘারে হাত রাখলো। তাকাতেই এক বড় আপু, বাহিরের দিকে বেশিক্ষন তাকানো যাবে না, চলে এসো। মন ভীষণ খারাপ আরও খারাপ হয়ে গেলো। রাস্তার ওপাশের বাড়িটি খুব সুন্দর মরিচ বাতি দিয়ে সাজিয়েছে। মনে হচ্ছে বিয়ে হবে গেইটও সাজিয়েছে। বারান্দা দিয়ে হলুদ শাড়ি পড়া মেয়েগুলোকে দেখা যাচ্ছে মাথায় হলুদ গাদার ফুল। আজ মনে হয় গায়ে হলুদ। বন্দী ঘরে থেকেও বিয়ে বাড়ির গন্ধ নিচ্ছে ও আয়োজন চোখে ভাসছে। ওর মনে পড়ে ওর ভাই বোন ও কাজিনদের বিয়ের কথা কত আনন্দ সে বিয়েতে। এখন হয়ত কারও বিয়ে হলেও আর আনন্দ করতে পারবে না, ভাবতে ভাবতেই চোখে জল চলে এলো। খাবারের সময় হলে সবাইকে কাঙালের মত প্লেট নিয়ে গিয়ে পাতিলের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে যেতে হয়। এই অভিজ্ঞতা একদম নেই রাখীর। এমনিতেই খাবারের ব্যাপারে বেশ রুচিশীল। তার পছন্দের আইটেম না থাকলে সে খেতে পারে না। ভর্তা, ডিম, চিংড়ি, ইলিশ, গরুর মাংস ওর ভীষণ পছন্দের। এগুলোর কোনটাই নেই ওদের খাদ্য তালিকায়। প্রতিদিন ঝোলের সবজি আর ঝোলের মাছ থাকে। এটা তো বাসা নয়, এত মানুষের খাবার রান্না করা সহজ বিষয় নয়। সবজি আর মাছের চেহারা দেখলে যে কারও খেতে ইচ্ছে করবে না। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার মেন্যু শুনে নিল রাখী। খাবারের যে অবস্থা তাতে ও খেতে পারবে না। এভাবে প্রায় ৩/৪ দিন ওর না খেয়ে কেটে গেলো। মায়ের মত কেউ প্লেট নিয়ে এসে এগিয়ে দিবে না, কেউ ভাত মেখে খাওয়াবে না। কেউ আর পছন্দের খাবার রান্না করে খাওয়াবে না। কারও কারও বাড়ি থেকে খাবার আসে। কারও বাবা মা আত্মিয় স্বজন প্রতিদিন এটা সেটা খাবার নিয়ে আসে। রাখীর কেউ আসে না। মাঝে মাঝে ভাই বোন আসে, রাখীর মোঝো ভাই বদলি হয়ে খুলনা চলে গেলেন। ইচ্ছে করলেও আসতে পারেনা। এই মাদ্রাসায় শিক্ষকদের কথা না শুনলে আর পড়াশোনা ঠিকমত না করলে ভয়ংকর শাস্তি পেতে হয়। একদিন কোরআান পড়ার সময় অমনোযোগী হওয়ার কারণে সবাইকে পিটিয়েছিল। একদিন একজনকে কঠিন বেত্রাঘাত করা হয় পড়ার সময় খেলা করছিল বলে। রাখীর খাওয়া দাওয়া বন্ধ শুনে বড় ম্যাডাম ডেকে জিজ্ঞেস করে, রাখী কোন সদুত্তর দিতে পারেনি। বলতে পারেনি মুখের উপর খাবার খাওয়ার অযোগ্য। রাখী আবার বারান্দায় গিয়ে দাড়ায় পড়াশোনার বিরতির মাঝে। প্রচণ্ড ক্ষিদে মাকে খুব মনে পড়ছে। গ্রীল ধরে দূর আকাশ পানে চেয়ে আছে। রাখী এখানে থাকতে পারবে না। ওর ভাই বোন কেউ আসলে তাদেরকে বলবে রাখী এখানে আর থাকতে চায় না। রাখী হোস্টেল সুপারকে ফোন দিতে বলল বাসায়। ওরাও বুঝে গিয়েছে রাখী এখানে থাকতে চায় না। রোজ রোজ কান্না করে। কান্না করতে করতে না খেয়ে একমাস পেরিয়ে গেলো। ওজন ৫ কেজি কমে গেলো। কেউ এলো না রাখীকে নিতে। দু তিনজন ভাই বোন মাঝে এলো, কিন্তু কেউ রাখীর কথা শুনতে চাইলোনা, কেউ গুরুত্ব দিল না। ভাবছে ঠিক হয়ে যাবে কিছুদিন পর। সবাই এটা সেটা নিয়ে এসে ওকে দেখে চলে যায়। রাখীর দম বন্ধ হয়ে আসছে। একমাস পেরিয়ে গেলো, কাঁদতে কাঁদতে চোখের জল শুকিয়ে এলো, কিন্তু তবু কেউ এলো না ওকে নিতে। রাখী সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক ওকে এই বন্দী জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাই সবাইকে কল করেও যখন কোন সুরাহা হল না। রাখী চিন্তা করল সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এখান থেকে বের হতে হবে। প্রথম দিন চেষ্টা করল, ব্যর্থ হল।পরের দিন একটা পলি ব্যাগে দুতিনটে কাপড় নিয়ে সোজা রওনা হল। বড় ব্যাগ নিলে ধরা পড়ে যাবে, তাই সব রেখে ছোট হাত ব্যাগ নিয়ে রওনা দিল, কাউকে কিছু না বলে। প্রথম গেইটের দারোয়ানকে খুব সহজেই ফাঁকি দিতে পারলো। দ্বিতীয় গেইটের দারোয়ান অন্য আরও দুজনের সাথে গল্পে ব্যস্ত ছিল তাই তাকেও ফাঁকি দেয়া গেলো খুব সহজেই। শেষ গেইটের দারোয়ানও ব্যস্ত ছিল কথা বলায়, চোখ পড়াতেই জিজ্ঞেস করল কোথায় যাচ্ছো আম্মাজান? ঐ পাশেই আমার বোনের বাসা আমি একটু আসছি। বলেই তরতর করে নেমে পড়লো রাখী, এমন একটা ভাব যে, কেউ ওকে পাঠিয়েছে, বা এটা ওর অধিকার যেতে দিতেই হবে। মাদ্রাসার হোস্টেল ভবন থেকে বের হয়ে রাখী মুক্ত আকাশে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিল। সকাল ১১ টা বাজে, শীতের সকাল, চমৎকার মিষ্টি রোদ। কোথায় যাবে রাখী তাই ভাবছে। ও এক বোনের বাসা আগারগাও তালতলা। ভাবছে সেখানেই যাবে। বের হয়েই রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল আগারগাঁও যাবে কিনা। দুই তিনটাকে জিজ্ঞেস করার পর একজন বলল যাবে। রিক্সা নিয়ে আগারগাওয়ের উদ্দেশ্য রওনা দিল। বড় বোনের বাসায় আগেও বেশ অনেকবার গিয়েছে। তাছাড়া আরও ভাই বোন এখানে থেকে পড়াশোনা করছে। আগারগাঁও আসার পর আর বাড়ি খুঁজে পায় না। মোড়ে আসার পর একটু ডানে বায়ে গিয়ে খোঁজ করার পর পেয়ে গেলো বাসা। বাসার নাম স্বপ্নের নীড়। রাখীর মনে আত্মবিশ্বাস ছিল যে করেই হোক বাসা সে খুঁজে পাবে। চার রাস্তার মোড়ে এসে যখন বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না তখনও সে বিচলিত হয়নি, ভয় পায়নি, খুব সাহসী ও শক্ত মনোবল ধারণ করে রাখী। বাসায় বেইল দেয়ার পর দুই তলা থেকে থেকে ওর সেজো বোন দেখে অবাক। বড় বোনের বাসা এটা, বড় বোনের বাসায় সেজো বোন থেকে পড়াশোনা করে। তারপর ধীরে ধীরে সবাই এলো। একা একা আসার জন্য সবাই বকাঝকা করল।সেজো ভাইয়ের স্বভাব শুধু মাইর দেওয়া। রাখী ছোট বলে ওকে কেউ মারতো না। সেজো ভাই মাইর দিল। রাখী খুব কান্না করল। আবার ওকে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে চাইল। রাখী কান্না করতে করতে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। যত বকুক মারুক সে আর সেই বন্দিখানায় যাবে না। সবার দুশ্চিন্তা একা একা কিভাবে এল, যদি অন্য কোথাও ওকে নিয়ে যেত, ভালো রিক্সাওয়ালা পেয়েছে, তাই ওকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছে।
রাখীর জীবনের নতুন চ্যালেঞ্জ ও নতুন অধ্যায় শুরু হল পারিবারিক আরেক বন্দী জীবনে।
স্বর্গরাজ্যের আলো